গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ ঢাকার চারপাশে চার উপশহর
7 months ago
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং একটি নির্দেশনা বাস্তবায়নের গতি ফিরছে। র্দীঘ কয়েক বছর পর এবার ঢাকার শহরের চারপাশে চারটি উপশহর গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এসব উপশহরে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষেকে। গত ২৮ মার্চ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাসিক সমন্বয় সভায় সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন মো. নবীরুল ইসলাম। ইতোমধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ৯-থেকে ১২টি স্থানের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, রাজধানীর ঢাকা শহরের উপকন্ঠে কেরানীগঞ্জে স্মাট সিটি এবং তুরাগ ওয়াটার বেজড সিটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চীনের একটি কোম্পানী এসব প্রকল্পের সমিক্ষা যাচাইয়ের কাজ ( ফিজিবিল্যাটি স্টাডি) শেষ করেছে। এসব প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠিছিলো রাজউক। তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এসব প্রকল্পের বিষয়ে কিছু পযবেক্ষণ করতে ফাইল ফেরত পাঠিয়েছে। রাজউক থেকে এসব প্রকল্পের প্রস্তাব এখনো পাঠানো হয়নি বলে জানা গেছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষেকে চারটি শহর গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে। মন্ত্রলণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠন করা হয়। এক কমিটি পরে চারটি এলাকা পরিদশন করে। এলাকা গুলো হচ্ছে,মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান, কেরানীগঞ্জ, মানিকগঞ্জের সিংগাইর ও ধামরাই উপজেলা। এছাড়া নারায়গঞ্জের সোনারগাঁ এবং নবাবগগঞ্জ উপজেলায় উপ-শহর গড়ে তোলার প্রতিবেদন দাখিল করেন।
রাজধানী স¤প্রসারণ করতে প্রকল্প হাতে নিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ঢাকার পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে গড়ে তোলা হবে এসব প্রকল্প। মূলত রাজধানীতে জনঘনত্বের চাপ কমাতেই এসব নতুন উপশহর গড়তে যাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে একটি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করে এখন চূড়ান্ত ধাপে রয়েছে। বাকি চারটেরও সম্ভাব্যতা যাচাই শেষের পথে। প্রকল্পগুলো গতানুগতিক থেকে ভিন্ন ধরনের হবে। বদলে যাবে গোটা রাজধানীর অবয়ব। প্রচলিত প্লটের পরিবর্তে দেওয়া হবে বøকভিত্তিক বরাদ্দ। আবার শিক্ষার জন্য বিশেষ অঞ্চল করা হচ্ছে। নদীভিত্তিক একটি করা হবে। তার নাম দেয়া হয়েছে তুরাগ ওয়াটার বেজড।
এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমান সরকার ইনকিলাবকে বলেন, আমাকে চেয়ারম্যান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে নিয়োগ দিয়েছে। আমার প্রথম কাজ হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রæতি দেয়া প্রকল্পের কাজ গুলো দ্রæত বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া রাজউকে ভালো কিছু করার জন্য সব কিছু ডিজিটাল করা হবে। তিনি বলেন এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকার রূপ বদলে যাবে। নতুন দিগন্তের ছোঁয়ায় লাগবে।
বুড়িগঙ্গার দক্ষিণপ্রান্তেই ঝিলমিল সংলগ্ন নেওয়া হয়েছে কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন। ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ে রোডের পাশে কেরানীগঞ্জ উপজেলার ঝিলমিল প্রকল্পের কাছেই নতুন উপশহরে থাকবে একটি বিশ্বমানের হাসপাতাল, অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্র্রিজ, ওয়্যার হাউস, ব্যাংকপাড়া। উপশহরটিতে সাড়ে কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হতে পারে। এক-একটি ভবনের উচ্চতা হবে কমপক্ষে ২০তলা। প্রকল্প এলাকায় ২০ শতাংশ জায়গা রাখা হবে গ্রীন স্পেস ও জলাভ‚মি হিসেবে। এছাড়া মাঠ, বাজারসহ সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে এই উপশহরে। এই উপশহরকে বিজনেস হাব হিসেবে গড়ে তুলতে চায় রাজউক। রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ঘোষণার পর এটিই প্রথম বøকভিত্তিক উন্নয়ন করে একটি আন্তর্জাতিকমানের শহর গড়ার পরিকল্পনা করেছে রাজউক। উপশহরটির প্রধান লক্ষ্য কর্মসংস্থান। পদ্মা সেতু হওয়ার পর দক্ষিণবঙ্গের কৃষিপণ্য সহজেই ঢাকায় প্রবেশ করতে পারছে। কাজেই ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ের পাশে যদি একটি উপশহর গড়ে ওঠে, সেটি হবে দেশের বিজনেস হাব। এতে ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এ প্রকল্পে অর্থের জোগান নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করতে চায় রাজউক। সেটি সম্ভব না হলে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় কাজ করার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার পর থেকে ৭ বছরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় রাজউক। এজন্য দেশী বড় বড় আবাসন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হতে পারে। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানকে লিজও দেওয়া হতে পারে। দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করেই এই শহর গড়া হবে। সব সুযোগ হাতে রেখেই প্রকল্প প্রস্তাব করবে রাজউক। তবে এখানে প্রচলিতভাবে সিঙেল প্লট দেওয়া হবে না। এখানে থাকবে বøকভিত্তিক বড় বড় প্লট। বেশিসংখ্যক মানুষের বাসস্থান সংকুলানের জন্যই নেওয়া হয়েছে এ পদ্ধতি। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন শহরের মানদন্ড মাথায় রেখে আন্তর্জাতিকমানের শহর গড়ার ভাবনা থেকেই এটা হাতে নেওয়া হয়েছে।
কেরানীগঞ্জের ১৬টি মৌজায় ২ হাজার ২৮৭ একর জমিতে আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পপত্র তৈরি করেছিল রাজউক। নতুন প্রকল্পপত্রে ঘরবাড়িগুলো বাদ দেওয়ায় এখন তা কমে ৯১২ একর নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৬ মৌজার পরিবর্তে এখন তিনটি মৌজার জমি অধিগ্রহণ করা হবে। মৌজা তিনটি হলো বেওথা, বাড়িলগাঁও ও তারানগর। প্লট হবে তিন হাজারের কাছাকাছি। কেরানীগঞ্জে আগে যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সেটা এখন ছোট করে ফেলা হয়েছে। যেসব স্থানে ঘরবাড়ি আছে সেগুলো বাদ দিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হবে সেসব ক্ষতিগ্রস্তের জন্য একটি অঞ্চল তৈরি করে প্লট দেওয়া হবে। এতে ওই এলাকার উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে।
এ বিষয়ে রাাজউক চেয়ারম্যান জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৌখিক নির্দেশনা পেয়েই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে ডিপিপি চূড়ান্ত করা হচ্ছে। তারপর যাবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে। এসব ধাপ পেরিয়ে নতুন বছরেই শুরু করা যাবে কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন। তিনি বলেন, এই নতুন উপশহরে কত বøক হবে তা আরও পরে চূড়ান্ত হবে। উন্নত দেশের শহরগুলো যেভাবে গড়ে উঠেছে তার থেকে ভালো আয়োজন থাকবে সেখানে। তাতে এককভাবে কাউকে প্লট দেওয়া হবে না। এক বিঘার প্লট দিলে ৪ জনকে দেওয়া হবে। দুই বিঘার প্লট হলে ৮ জন পাবে। এটা করতে পারলে দেখা যাবে কোনো প্লট যদি ১২ জনকে দেওয়া হয়। তা হলে সেই প্লট সুউচ্চ ভবন বানাতে পারবে। প্রকল্প এলাকার ভেতরে খেলার মাঠ করতে পারবে। এটি আন্তর্জাতিকমানের উপশহর হবে।
কেরানীগঞ্জের পাশেই মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর এলাকায় জরিপ কাজ শেষ। এখানেও গড়ে তোলা হবে বিশেষ প্রকল্প। অত্যাধুনিক এই প্রকল্পে প্রাধান্য দেওয়া হবে স্থানীয়দের। বছরতিনেক আগে এ উদ্যোগ নেওয়া হলেও করোনার জন্য অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। নতুন বছরেই সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে পরবর্তী ধাপের কাজ শেষ করা যাবে। রাজউকের পরিকল্পনা রয়েছে, নবাবগঞ্জ-দোহার-মাওয়া এলাকায় পদ্মা নদীর পাড়ে একটি প্রকল্প করার। পূর্বাচলের দক্ষিণে হবে শিক্ষা জোন আর পূর্বদিকে হবে আরেকটি আবাসন প্রকল্প। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিশুপুত্র শেখ রাসেলের নামে শেখ রাসেল ওয়াটার বেজড বিনোদন পার্ক’ নামে একটি প্রকল্প নিয়েছে নিয়েছে রাজউক। ঘাটারচরের ওই স্থানের বেশিরভাগই নালা- ডোবা। সরকারি খাস হিসেবে চিহ্নিত ওসব জমির কিছু অংশ দখলদাররা ভরাট করে দখল করে রেখেছে। তাদের উচ্ছেদ করে সেখানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এখানকার ডোবা ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখেই পরিকল্পনা করা হয়েছে শেখ রাসেল ওয়াটার বেজড পার্ক। শেখ রাসেল ওয়াটার বেজড বিনোদন পার্কের কাজটা দ্রæতই শুরু হবে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর সংলগ্ন বছিলা ব্রিজ পার হয়ে সামনের ঘাটারচর এলাকায় ৫০ দশমিক ৭০ একর জমির ওপর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে ১০ দশমিক ৭২ একর খাসজমি। বাকিটা আশপাশ থেকে অধিগ্রহণ করা হবে। এ প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫ শ’ কোটি টাকা। এ বিনোদন পার্ককে আকর্ষণীয় করার জন্য থাকবে এম্ফিথিয়েটার, কমিউনিটি সেন্টার, অফিস ভবন, ওয়াচ টাওয়ার, ব্যায়ামাগার, আধুনিক রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, সাঁতারকাটা, নৌকা ভ্রমণসহ বিভিন্ন ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষের বনভোজন বা পারিবারিক অনুষ্ঠানের সুযোগ থাকবে। তুরাগে ওয়াটার বেজড মডেল টাউন। এদিকে রাজধানীর আমিনবাজার, মিরপুর, সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের কাশিমপুরের অংশবিশেষ নিয়ে একটি বৃহৎ আবাসন প্রকল্প হাতে নিয়েছে রাজউক। তুরাগ তীর ঘেঁষে সাভার ও আশুলিয়ার বিশাল এলাকা ভ‚মিদস্যুদের হাত থেকে রাজউক রক্ষা করতে পারছে না। বর্ষা মৌসুমে রাতেরবেলায় নৌকায় করে তারা বালু ফেলে। শুষ্ক মৌসুম শুরু হতেই সেখানে চর জেগে ওঠে। এভাবে আশুলিয়ার বিশাল এলাকা ইতোমধ্যে ভরাট হয়ে গাছপালা গজিয়েছে। এ জন্যই আমিনবাজার থেকে কাশিমপুর পর্যন্ত পুরো এলাকা অধিগ্রহণ করে তুরাগ নদ ও ডোবা গুলো রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এ প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে। এখানেও যেসব স্থান ভরাট হয়ে গেছে সেখানে প্লট বানিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হবে।